আতিকুর রহমান মানিক

৬ আগস্ট আজ, হিরোশিমা দিবস। আধুনিক বিজ্ঞান মানবজাতির উপর চরম অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছিল আজকের এ দিনে। ৭২ বছর আগে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল বেলা জাপানের হিরোশিমায় আমেরিকার বিমান থেকে ছোঁড়া হয় বিশ্বের প্রথম পারমানবিক বোমা “লিটল বয়”। সূচিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের এক কলঙ্কিত কালো অধ্যায়ের। আর ৩ দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে ফেলা হয় পারমানবিক “ফ্যাটম্যান”। এই বোমা ফেলা হয় রাতের বেলা ঘুমন্ত মানুষের উপর। সেই বোমা নিক্ষেপকারী ও গনতন্ত্রের ঠিকাদার আজকের আমেরিকাই কিন্তু ইরাকযুদ্ধ শুরু করেছিলো ইরাকে পারমানবিক অস্ত্র আছে এই ধুঁয়া তুলে। এবার একটু ফ্ল্যাশব্যাক :-
পারমানবিক বোমার ইতিহাস:
১৯৩৮ সালের ৭ ডিসেম্বর নাজি জার্মানির দুই বিজ্ঞানী অটো হার্ন এবং ফ্রিৎজ স্ট্রাসমান সফলভাবে অণু ভাঙার পর সে দেশে আণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু হলে ২ আগস্ট, ১৯৩৯ আলবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে জার্মানের সম্ভাব্য পরমাণু বোমা হামলা সম্পর্কে সতর্ক করে দেন এবং আণবিক গবেষণায় জোর দেয়ার দাবি জানান। ১৯৪২ সালের জুনে পদার্থ বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেন হেইমারের নেতৃত্বে মানহাটান প্রকল্পে গোপন আণবিক অস্ত্র কর্মসুচি শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর এনরিকো ফেরমির নেতৃত্বে মার্কিন বিজ্ঞানীরা বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি করেন।
লিটল বয় ও ম্যানহাটন প্রকল্প: পারমানবিক বোমা তৈরি করার প্রকল্পের নাম ম্যানহাটন প্রকল্প। এই প্রকল্পের জন্য ১৭৫,০০০ জন লোক কাজ করেছিলো। আর খরচ হয়েছিলো প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। । প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী জে. রবার্ট ওপেনহেইমার। প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের মধ্যে রয়েছেন ফিলিপ এইচ আবেলসন, হান্স বেটে , সেথ নেডারমেয়ার, জন ফন নিউমান, ইসিদোর ইজাক রাবি, লিও জিলার্দ, এডওয়ার্ড টেলার, স্তানিসল’ উলাম, নিল্স বোর, জেম্স চ্যাডউইক, এনরিকো ফের্মি, রিচার্ড ফাইনম্যান, অটো ফ্রিশ্চ, জর্জ কিস্তিয়াকোভ্স্কি, আর্নেস্ট লরেন্স, ফিলিপ মরিসন, হ্যারল্ড উরে এবং ভিক্টর ওয়েইজকফ। প্রকল্পে কাজ শুরু করার আগেই এদের মধ্যে ৫ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং যুদ্ধের পর এখান থেকে আরও ৩ জন নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।ম্যানহাটন প্রকল্প ৪টি পারমানবিক বোমা বানিয়েছিল। এর মধ্যে ট্রিনিটি নামক প্রথম বোমাটি নিউ মেক্সিকোর আলামোগোর্ডোর নিকটে পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরিত করা হয়। অন্য দুটি লিটল বয় ও ফ্যাট ম্যান বোমা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট এবং ৯ আগস্ট তারিখে যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত হয়। শেষ বোমাটি আগস্টের শেষ দিকে জাপানের উপর নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৪২ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৪৬ সালে একে এটমিক এনার্জি কমিশনের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়।
লিটল বয়: হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমটির নাম “লিটল বয়”। এটি নিক্ষেপের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। তিনি ছিলেন আকারে ছোট আর তাই এই বোমার নাম দেয়া হয় “লিটল বয়”। তবে বোমাহামলার নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুম্যান। বোমা বহনকারী বিমানটি ছিল বোয়িং বি-29 Superfortress Enola Gay , আর সেই বিমানের পাইলট ছিলেন কর্নেল পল । হামলা পরিচালনা করেন Tibbets এর 393rd বমবার্ডমেন্ট স্কোয়াড্রন, ভারি অফ, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী । এক নজরে ‘লিটল বয়’: • তেজস্ক্রিয় পরমাণু: ইউরেনিয়াম -২৩৫ • ওজন: চার হাজার কেজি, দৈর্ঘ্য: ৯.৮৪ ফুট, পরিধি: ২৮ ইঞ্চি • বোমা পতনে সময় লাগে : ৫৭ সেকেন্ড • বিস্ফোরণের মাত্রা: ১৩ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য।

হিরোশিমা মিশন: ১৯৪৫ সালের ৫ আগস্ট ‘মেজর জেমস আবি হপকিং’ স্বাক্ষরিত নির্দেশনার মধ্য দিয়ে চুড়ান্ত হয় হিরোশিমা মিশন। এই মিশনে অংশ নেয় মোট ৭ টি বিমান। তিনিয়ান দ্বীপ থেকে ‘এ্যানোলা গে’ নামক বিমানে করে ‘লিটল বয়’কে নিয়ে পাইলট পল ওয়ার ফিল্ড টিবেটস রওয়ানা দেন স্থানীয় সময় রাত ২টা ৩০ মিনিটে আর এ্যানোলা গে’কে নিয়ে যান তিনিয়ান দ্বীপ হতে ১৭০০ মাইল পথ অতিক্রম করে হিরোশিমার আকাশে।
পাইলট পল ওয়ার ফিল্ড টিবেটস সহ ‘এ্যানোলা গে’র সাতজন ক্রু
৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সালের হিরোশিমার সকাল: জাপানের রাজধানী শহর টোকিও থেকে ৫০০ মাইল দূরে অবস্থিত হিরোশিমা শহরে তখনো জনপদ কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠেনি। সবে মাত্র জেগে উঠেছে আধেক শহর কমর্ময়তায়। হিরোশিমায় তখন নরম রোদের সকাল নেমে এসেছে। সকাল সাতটায় পর পর বিমান হামলার সতর্ক সাইরেন বেজে ওঠে। ভীত সন্ত্রস্ত হিরোশিমার মানুষজন দেখে হিরোশিমার আকাশে অনেক উঁচুতে কয়েকটি মার্কিন যুদ্ধবিমান চক্কর দিচ্ছে। অল্প পরেই বিমানগুলো দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে যায়। সাড়ে সাতটায় বেজে ওঠে বিপদমুক্ত সাইরেন। হিরোশিমাবাসী ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস। কিন্তু সকাল আটটায় আবার তিনটা বিমান আকাশে আর্বিভূত হয়। হয়তো ভাবে যুদ্ধতো সামরিক বিষয়, নিশ্চয়ই বেসামরিক এলাকায় বিমানগুলো কোন ক্ষতি করবে না। এগুলো ক্ষতিকর বিমান নয় ভেবে আর কোন সাইরেন বাজানো হয়নি। কিন্তু কিছু সময় পরই ঘটে গেলো বিভীষিকা।

হিরোশিমায় লিটল বয়ের বিস্ফোরণে ছত্রাকার কুণ্ডলী :-
তিনিয়ান থেকে যাত্রা পথে ক্যাপটেন পর্সন্স ও ইলেকট্রনিক বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট জেপসন ‘ লিটল বয়’র সংযোজনের কার্য চূড়ান্ত করেন। লক্ষ্য থেকে ত্রিশ মাইল দূরে অবস্থান কালে সকাল সাতটা ত্রিশ মিনিটে ক্যাপটেন পর্সন্স কর্তৃক ‘লিটল বয়’র গায়ে লাল প্লাগ সংযোজনের মাধ্যমে প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়। আটটা পনেরো মিনিটে হিরোশিমার আকাশ হতে প্রায় ছয় মাইল (৩১,৬০০ ফুট) উপরে অবস্থান কালে ২৬ বছর বয়সী মেজর ফেরেবী (Ferebee) চূড়ান্ত নিক্ষেপের কাজটি সম্পন্ন করেন। ৪৩ সেকেন্ড পর ভূ-পৃষ্ঠের ১৮৯০ ফুট উপরে বিস্ফোরিত হয় ‘লিটল বয়’। পরিণতি: বানিজ্যিক ও অফিস আদালতের স্থানে হিরোশিমায় বোমাটি ছোঁড়া হয়। বিস্ফোরণের সাথে সাথে ৫০০ মিটার বৃত্তের মাঝে আলিশান দালান চোখের পলকে ধূলিস্মাত হয়ে যায়। ৫ বর্গমাইল এলাকা ছাই ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। তখন নগরীতে লোকসংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৫০ হাজার। বোমার তাৎক্ষণিক বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয় এক লাখ দশ হাজার নীরিহ জাপানি অধিবাসীর। দীর্ঘমেয়াদী তেজস্ক্রিয়তার কারণে পরের বেশ কয়েকটি বছর ক্রমাগতভাবে মৃত্যু হয় আরো এক লাখ ত্রিশ হাজার লোকের। এখনো জাপানের অধিবাসীরা সেই তেজস্ক্রিয়তার মাসুল দিয়ে যাচ্ছেন। বোমা নিক্ষেপের সময় থেকে ১০ আগষ্ট পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৬৬১ জন। এর মাঝে সামরিক লোক মৃত্যুবরন করে প্রায় ২০,০০০ জন।
বোমা ফেলার আগে ও পরে, গ্রাফিক্সে
হিরোশিমা prefectural স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমান, বিস্ফোরণ দিনে যারা মারা গেছে তাদের মাঝে ৬০% ফ্ল্যাশ বা অগ্নিশিখা পোড়া, পতনশীল ধ্বংসাবশেষ থেকে ৩০% এবং অন্যান্য থেকে ১০%। আমেরিকা দাবী করে হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপ করায় জাপান আত্মসমর্পণ করে। ফলে নিশ্চিত হতাহত থেকে রক্ষা পায় অনেক প্রাণ। কিন্তু জাপানের দাবী তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আত্মসমর্পণের। তবে রাশিয়ার হস্তক্ষেপেই জাপান আত্মসমর্পণ করে এমনটাই দাবীর উল্লেখ পাওয়া যায় রেডিও রাশিয়ার।
আজ আমরা দেখি গনতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা এই আমেরিকা। কিন্তু হিরোশিমা-নাগাসাকি, ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্হানসহ বিভিন্ন দেশে সংঘঠিত ধ্বংসলীলা কি বলে ? মানুষ হত্যার নায়কদের মুখে গনতন্ত্রের শ্লোগান কতটুকু মানায় ? পারমানবিক মারণাস্ত্রের আঘাতে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে গণহত্যা এবং বর্বরতম ধ্বংসযজ্ঞের ৭২ বছর পরেও কি এর বিস্তাররোধ হয়েছে? বরং আমরা দেখছি, নিত্য-নতুন মারনাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে হালের পরাশক্তিগুলো। আর এতে বিপন্ন হচ্ছে মানবতা ও মানবাধিকার। দুনিয়া কাঁপানো হিরোশিমা ট্রাজেডির ৭২ বর্ষপূর্তি আজ। আজকের এ দিনে পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত একটি বিশ্বের স্বপ্ন কি আমরা দেখতে পারিনা ?

আতিকুর রহমান মানিক,
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী,
মুঠোফোন – ০১৮১৮-০০০২২০।